বাংলা সাহিত্যের গোয়েন্দা উপন্যাসের ধারাটা এখনো পর্যন্ত খুব যে একটা পরিণত তা না। ব্যোমকেশ আর ফেলুদা কে একপাশে সরিয়ে রাখলে সব শ্রেণীর প...
বাংলা সাহিত্যের গোয়েন্দা উপন্যাসের ধারাটা এখনো পর্যন্ত খুব যে একটা পরিণত তা না। ব্যোমকেশ আর ফেলুদা কে একপাশে সরিয়ে রাখলে সব শ্রেণীর পাঠকের বুক সেলফে ঠাঁই পেয়েছে এমন বই বের করা মুশকিল। নীহার রঞ্জন গুপ্তের কিরীটি ঠিক সময়ের গন্ডি পেরিয়ে আসতে পারে নি, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাকাবাবু কখনো কখনো অতিমাত্রায় শিশুতোষ, সুচিত্রা ভট্টাচার্যের মিতিন মাসি, সমরেশ মজুমদারের অর্জুন বা শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের এর শবরের জনপ্রিয়তা বাংলাদেশে তেমন নেই। বাংলাদেশের কথা যখন এসেই পড়ল তাহলে দেখা যাক এখানকার অবস্থা... ।। যদি মৌলিক উপন্যাসের কথা বলি নাজিম উদ্দিন বা শেখ আব্দুল হাকিমের বাইরে কাউকে সেভাবে খুঁজে পাওয়া কষ্টকর।
লেখক আবু ইসহাক কে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কিছু নেই। স্কুল লেভেলে তাঁর লেখার সাথে পরিচয় হয়ে যাই আমাদের। আর যারা মোটামুটি বইপত্র পড়েন তাদের কাছে সূর্য দীঘল বাড়ী সুপরিচিত নামই। তবে গোয়েন্দা উপন্যাস আর আবু ইসহাককে মেলানো একটু কষ্টসাধ্য, আসুন একটু লেখকের ভাষ্য থেকেই মিলিয়ে নিই-
"আমার প্রথম উপন্যাস 'সূর্য-দীঘল বাড়ী' লেখা শেষ হয় ১৯৪৮ সালের আগস্ট মাসে । তারপর চার-চারটে বছর প্রকাশকের সন্ধানে কলকাতা ও ঢাকায় ঘোরাঘুরি করেও বইটির প্রকাশক পাইনি । হতাশ হয়ে ভাবলাম, ডিটেকটিভ উপন্যাস লিখলে হয়তো প্রকাশক পাওয়া যাবে ।"
এরপরের ৩৪ বছর "জাল" উপন্যাসটি ছিল বাক্সবন্দী।। মূলধারার উপন্যাসে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ায়, সুনাম খোয়ানোর ভয়ে লেখকও আর আলোর মুখ দেখান নি উপন্যাসটিকে। আমরাও খুব সম্ভবত বঞ্চিত হলাম আরো ভালো কিছু গোয়েন্দা উপন্যাস পাওয়া থেকে।
খুনের রোমহর্ষকতা বা গুপ্তধন আবিষ্কারের উত্তেজনা বোধ হয় পাঠককে একটু বেশিই নাড়া দেয়, তাই বেশিরভাগ পাঠকপ্রিয় গোয়েন্দা উপন্যাস এসব নিয়েই। আপনাকে মুদ্রা জালিয়াতি নিয়ে কোন লেখা জিজ্ঞেস করি, হুট করে বলা হয়তো মুশকিল হবে। অথচ মুদ্রা জালিয়াতি যে খুব দুর্লভ ঘটনা তা না। এর ক্ষতিও কিন্তু বেশ, যদিও কিছুটা অর্থনৈতিক জ্ঞান না থাকলে তা বোঝা মুশকিল। সঙ্গত কারণেই বেশিরভাগ মানুষই চেষ্টা করে জাল টাকা পেলে তা হাতবদলের। "জাল" উপন্যাসের গল্প এই জাল নোট নিয়েই। উপন্যাসটা হয়ত মাস্টারপিস না, তবে বাংলা সাহিত্যের অপরিণত এই ধারার মধ্যে অন্যতম তো বটেই। আর লেখকের পেশাগত অভিজ্ঞতা এই গল্পের প্রাণ।
১৯৪৭, দেশ সদ্য স্বাধীন। স্রোতের মতো শরনার্থী আসছে ওপার থেকে। ওপারের টাকা এপারে অচল, তাই শরনার্থীরা একে ওকে ধরে ভারতীয় টাকাকে পরিবর্তন করছে পাকিস্তানি টাকায়। এই সুযোগেই চলছে জাল মুদ্রার রমরমা কারবার। পুলিশের স্পেশাল অফিসার আলী রেজার অধস্তন ইলিয়াস আলীর হাতে পড়ে এই দুষ্টচক্র ভাঙার ভার। এই চরিত্রের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হলো, একে এমনভাবেই গড়া যেন আপনি একে গোয়েন্দা উপন্যাসের সুপারম্যানের চেয়ে কোন সাধারণ পুলিশ অফিসার হিসেবেই ভেবে স্বস্তি পান। ইলিয়াস আলী বুদ্ধিতে জালিয়াত চক্রের দিনাজপুরের এক এজেন্টের কাছে পাঠানো এক চিঠির ইন্টাসেপ্ট সম্ভব হয়। এবার ইলিয়াস আলীর সামনে আরেক চ্যালেঞ্জ,চিঠিটি ক্রিপ্টোগ্রাম ব্যবহার করে লেখা। এরপর কেমন করে খুললো ক্রিপ্টোগ্রামের জট!! কিভাবেই বা জালিয়াতির শিকার এক রিফিউজি পরিবারের সাধারণ মেয়ের সহায়তায় ভাঙ্গা সূত্র জোড়া লাগিয়ে পাওয়া গেল দুষ্টচক্র ভাঙ্গার মন্ত্র তা না হয় আপনিই পড়ে আবিষ্কার করুন। ইলিয়াস আলীর সাথে না হয় একটু ঘুরেই বেড়ান দিনাজপুর থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত।। ও হ্যাঁ "জাল" এ আপনার জন্য বোনাস হিসেবে আছে একটু রোমান্টিসিজম আর ধর্মান্ধতার কথা।।
উপন্যাসের দুর্বল দিক হলো ইলিয়াস আলী ছাড়া বাকি চরিত্রগুলো ভালোভাবে ডেভলপড হয় নি আর গোয়েন্দা উপন্যাসের টানটান উত্তেজনা ও হয়ত আপনি পাবেন না। তারপরও, যদি আপনি বাস্তবধর্মী, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং ভিন্নধর্মী প্লটের কোন গোয়েন্দা উপন্যাস পড়তে চান, "জাল" আপনার জন্যই।
No comments