ইমনের সাথে কখন পরিচয় ঠিক ঠাহর করতে পারছি না। হতে পারে ২০১৪ সালে। সবে ইন্টার পাশ করে কয়েকজন বন্ধুবান্ধব মিলে কিছু টাকা কালেকশন করে বাচ্চা...
ইমনের সাথে কখন পরিচয় ঠিক ঠাহর করতে পারছি না। হতে পারে ২০১৪ সালে। সবে ইন্টার পাশ করে কয়েকজন বন্ধুবান্ধব মিলে কিছু টাকা কালেকশন করে বাচ্চাদের নতুন কাপড় দিব ভাবলাম। হতে পারে সেবার তাকে একটা নতুন গেঞ্জি বা শার্ট দিয়েছিলাম। কিংবা দেইনি।
তখন ইমনকে আলাদা করে চেনা হয়নি। দেবপাহাড় বস্তিতে প্রায় একই বয়সি এত বাচ্চা! আর আমার মানুষ ভোলার রোগ! এরপর ২০১৫, তারপর ২০১৬!
২০১৬ একটা যুগান্তকারী সাল ছিল। আমরা এই দেবপাহাড়ে একটা স্কুল দেই। অবশ্য স্কুল দেওয়ার প্ল্যান ছিল USTC বিশ্ববিদ্যালয়ের পেছনের বস্তিতে। জায়গাও দেখে ফেলি কয়েকজন মিলে।
কিন্তু নানান কারণে ওদিকে আগানো হয়নি। আর দেবপাহাড় আমাদের আপন করে নেয়। তারাই বলে বাচ্চারা পড়াশোনা করে না, আমরা কিছু করতে পারি নাকি!
দেবপাহাড়েই এক বন্ধুর বাসা ছিল। প্রায়শই ওদিকে যাওয়া হত। আর আড্ডা হত চকবাজার। তো দেবপাহাড় লোকেশনটা আমাদের জন্যে সুবিধার ছিল। আর বস্তির মানুষগুলো অনেক ভাল, আমাদের আপন করে ফেলে। আমরাও তাদের নিজের ভাবা শুরু করি।
এরপর শুরু হয় 'বর্ণমালা ইশকুল'। অনেক প্রতিকূলতা, অনেক সমস্যার মধ্যেও কোন রকমে চলে আমাদের ইশকুল।
শুরুতে কতজন স্টুডেন্ট ছিল মনে নাই। পুরানো কাগজপত্র খুঁজলে হয়ত পেয়ে যাব। এই ধকলে না যাই আর, মোটামুটি ৩০ জনের আশেপাশে হবে। অবশ্য সবাই স্কুলে আসতো এমন না।
স্কুলে আনার জন্যে প্রায়শই খাবারদাবার দিতে হত বাচ্চাদের, আরো নানান ভাবে স্কুলে আনার চেষ্টা করতাম। কখনো ৫ টাকার কেক বা চকলেট, কখনো বা জন্মদিনের কেক।
আমাদের এই বর্ণমালা ইশকুলের একজন মনোযোগী ছাত্র ছিল ইমন। ইমনকে চিনার আগে তার আম্মুকে চিনে ফেলি আমরা। আন্টি প্রায়ই এসে কথা বলতো, আমার ছেলেটারে দেখবেন, সে যাতে পড়াশোনা করে। প্রয়োজনে ৪/৫টা বাসায় কাজ করব কিন্তু পড়ালেখায় কমতি দিব না এসব কথাবার্তা।
আমরা মাঝেমধ্যেই গার্জিয়ান গ্রুমিং করতাম। বাচ্চার মা বাবাদের সাথে বসে বাচ্চাদের পড়াশোনা নিয়ে আলোচনা করতাম, পড়াশোনার গুরুত্ব বুঝাতাম। আর এই গার্জিয়ান গ্রুমিংএ সবার আগে এসে হাজির থাকতো ইমনের আম্মু।
সেভাবেই ইমনকে চেনা। ওদের ক্লাসে ৩/৪ জন ছিল। প্রতি বছর একজন দুজন ড্রপ আউট।
স্লামে পড়া কষ্ট।
ঘর নাই ঠিকঠাক। এক রুমে গাদাগাদি করে থাকে পরিবারের সবাই। সন্ধ্যা হলেই আন্ধার, বিদ্যুৎ নাই। পানি সমস্যা, খাবারের সমস্যা। কী এক সমস্যা ময় জীবন!
এত সংকটের মধ্যে বাচ্চাগুলা বেঁচে থাকে এটাই অনেক, পড়াশোনা যা হয় তা-ই একটা 'উপরি পাওনা'!
সেখান থেকেই ইমন পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিল। ওর ক্লাসের ড্রপ আউট, চুলে তেল মেরে, সিগারেট ফুঁকা শুরুও করেছে কেউ কেউ লুকিয়ে, আর ইমন বসতো বই নিয়ে।
স্টুডেন্ট হিসেবে একদম অসাধারণ ছিল এমন না। মাঝারি রকমের। কিন্তু মানুষ হিসেবে অনেক ভাল ছিল।
আমি ইমনকে কখনো বকা দিছি বলে মনে পড়ে না। শুধু আমি না, আমাদের কাউকেই ওকে বকাবকি করতে হয় নাই পড়াশোনা কিংবা ম্যানার নিয়ে।
ছেলেটা কিঞ্চিৎ ইন্ট্রোভার্ট ছিল। স্কুলে ঘন্টা বাজলেই ব্যাগ কাঁধে এসে পিছনের বেঞ্চে বসে পড়া শুরু করত। দুষ্টামি বা এসবে ছিল না।
চুল একটু বড় রাখতো। রাহাতের চুল ছিল সবার চেয়ে বড়। চুল বড় রাখার জন্য রাহাতকে পানিশমেন্ট দেওয়ার পর রাহাত বলতো, স্যার ইমনের চুল ওতো বড়, রবিনেরও, ওদেরও শাস্তি দেন!
তখন চুল মুঠো করে ধরার চেষ্টা করতাম, ধরতে পারলেই শাস্তি। চুল থাকা লাগবে মুঠোর চেয়ে কম! অবশ্য মাঝেমধ্যে ওরা এক জোট হয়ে বলতো, স্যার আপনার চুল তো আমাদের সবার চেয়ে লম্বা!
ইমন খেলাধূলায় ভালই ছিল। স্কুল বা আমাদের স্পোর্টস ডে তে অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। কাজেম আলীতে পুরষ্কারও পায়।
এই ছয় বছরে কত স্মৃতি, পড়াশোনা, প্রোজেক্ট কত কী!
ঈদে, মেহেদী উৎসবে, বিজয় দিবসে, ভাষা দিবসে আরো কতশত কারণে অকারণে একসাথে দিন কাটে!
আমাদের সবার পছন্দের ছিল ইমন।
ছেলেটা সম্ভবত বয়সের তুলনায় বেশি বুঝদার ছিল। সে বুঝতো তার বাবা মা তার পড়াশোনার জন্যে কষ্ট করে। সে বুঝতো আমরা ভার্সিটি থেকে গিয়ে আড্ডা বাদ দিয়ে গরমে অন্ধকারে তাদের ভালর জন্যেই তাদের পড়াচ্ছি।
এই জন্যেই বোধহয় সারাদিন আন্টি অন্যদের বাসায় কাজ, আংকেল বাইরে কাজ করলেও সে বাসায় বসে পড়াশুনা করত। না করলেও কিন্তু হত, দেখার কে-ই-বা ছিল?
আশেপাশের সবার কাছেই ইমন প্রিয় ছিল।
আজ যখন ইমনের লাশের দিকে হাটছিলাম, দেখি সবাই মুখ লুকিয়ে কাঁদছে। এর মাঝে ইমনের মা'কে বুঝা যাচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল বস্তির সব আন্টিই বোধহয় ইমনের মা।
স্কুলের বাচ্চাদের সবার নাম মনে নাই এখন, অনেকদিন যাই না। চেহারাও পালটে গেছে অনেক।
মাঝে কভিডের পর যখন একবার গেলাম, ইমনকে দেখে অবাক। ওকে দেখে বলি, কিরে ইমন তোর তো মোচ উঠে গেল! বড় হয়ে গেছে, টিনএজে কত দ্রুত পরিবর্তন হয়ে যায়!
তখন খেয়াল হল, প্রথম দেখেছিলাম সেও প্রায় ৮ বছর আগে! কত সময় এই মানুষগুলোর সাথে কাটলো!
ইমনের সাথে শেষ দেখা ১৬ ডিসেম্বর ২০২২। স্বস্তি ও বৃত্তের ইভেন্ট ছিল। দেখি ইমন ঘরের সামনে বসে আছে। আমাকে দেখে সালাম দিল, তাকিয়ে দেখি চোখ ফুলে আছে আর লাল। ভাবলাম চোখ উঠেছে।
মাঝে এটা তীব্রভাবে সবখানে সবার হচ্ছিল, তো জিজ্ঞেস করলাম, কিরে ব্যাটা চোখ উঠছে? সে কিছু না বলে বিখ্যাত হাসি দেয়!
বললাম সমস্যা হলে ডাক্তার দেখাইস। আর জানাইস!
আর ফেরার পথে দেখা হয় নি।
তারপর শুনলাম, দেখা হওয়ার ১১তম দিনে সকালে ইমন মারা গেছে।
বস্তির কাছে পৌঁছুনোর পর দেখি একটা লাল এম্বুল্যান্স। বুঝলাম, ইমন! হাটা যাচ্ছিল না, সামনে এগুনো যাচ্ছিল না।
যখন চেহারা দেখলাম, মনে হচ্ছিল ঘুমিয়ে আছে, ডেকে বলি, ইমন কিরে, তোর তো মোচ উঠে গেছে!
কফিন এম্বুল্যান্সে ছিল, ইচ্ছা হচ্ছিল উঠে একবার ধরে ডাকি ইমনকে। উঠা হল না, একবার ধরা গেল না।
ইমন একটা বিশাল বড় জায়গা জুড়ে থাকবে সবসময়। এই ইমনদের জীবন একটু ভাল করার জন্যে আমরা কতশত মানুষ বছরের পর বছর রাস্তায় কাজ করি, হঠাৎ ইমন বিদায় নিয়ে ফেললে মানা যায় না। কষ্ট লাগে। মনে হয়, নাহ এটা ঠিক হয় নাই, ইমন মরবে কেন? ইমনকে মরতে হবে কেন?
ইমন বড়জোর অসুস্থ হতে পারে, ইমন এক্সিডেন্ট করতে পারে, ইমনের জ্বর হতে পারে। কিন্তু ইমন মরবে কেন?
তুই মরিস নাই, তুই আমাদের মাঝেই আছিস, সবসময় থাকবি।
ইমন তোর জন্যে ভালবাসা।
[লিখা যাচ্ছে না ইমনকে নিয়ে, অন্য একদিন অবশ্যই লিখব, অনেক কিছু লেখা বাকি, ইমন!]
No comments