বেশ কয়েকদিন আগে, হাসপাতাল থেকে ফিরছি। পায়ে ব্যান্ডেজ এবং এনেস্থিসিয়ার প্রভাব কমতে শুরু করায় হাটতে কষ্ট হচ্ছিল। রাস্তায় ঔষধ কিনার জন্যে থাম...
বেশ কয়েকদিন আগে, হাসপাতাল থেকে ফিরছি। পায়ে ব্যান্ডেজ এবং এনেস্থিসিয়ার প্রভাব কমতে শুরু করায় হাটতে কষ্ট হচ্ছিল। রাস্তায় ঔষধ কিনার জন্যে থামতে হলো।
বিরস দুপুর, কভিড সংক্রমণের হার উর্ধ্বমুখী। করোনার প্রথম ঢেউ চলছে। রাস্তায় মানুষজন প্রায় নেই। তাপমাত্রা প্রায় ৩৬ এর কাছাকাছি।
অনেক মাস পর বের হওয়া, আবার বের হয়েই হাসপাতালে যেতে হয়েছে। এই সময় গুলোয় কোন অপরিচিত মানুষ দেখা হয় নি, কথা বলা তো দূরের ব্যাপার।
আমি প্রচুর কথা বলি, অন্তত সেজন্যে না হলেও এনেস্থিসিয়ার অবন্ধুত্বসুলভ আচরণের জন্যেও কারো সাথে কথা বলে খেয়াল সরানো আবশ্যক হয়ে উঠেছিল।
তখন রিক্সাওয়ালা মামার সাথে কথা বলছিলাম, জীবনে করোনার প্রভাব নিয়ে।
উনার ভাষ্যমতে,
তিনি প্রতিদিন সকালে রিক্সা নিয়ে বের হতেন। রিক্সাটা নিজের। জামালখানের আশেপাশেই রিক্সা চালান। দুপুর হতেই ১৩০০/১৫০০ টাকা কামান। এরপর বাসায় চলে যান।
সারাদিনে আর রিক্সা চালান না বা অন্য কোন কাজ করেন না। বাকি সময় ঘুমান কিংবা ঘুরে বা আড্ডা দিয়ে কাটান।
উনার বউ দুই ছেলে সহ গ্রামে থাকে। ছোট ছেলে অসুস্থ। প্রতিদিন ১০০০/১১০০ টাকার ঔষুধ লাগে। উনি মুলত তাই ১৩০০/১৫০০ কামালেই আর কাজ করেন না। ছেলেকে টাকা পাঠিয়েই শেষ। এভাবেই কাটছিল অনেক বছর।
করোনায় সব বন্ধ হওয়ার পর আর এত ইনকাম করতে পারছেন না। এখন সারাদিন রিক্সা চালিয়েও ১০০০ কামাতে পারেন না। তাই আর গ্রামে যান না। ছেলের অবস্থা খারাপ হচ্ছে।
তিনি এর জন্যে ভাগ্যকে দোষারোপ করছেন। করোনা না হলে আর উনার জীবনে এত কষ্ট আসতো না। উনি এমনই মনে করেন।
সে যাক,
এই গল্পের একটা অর্থনৈতিক দিক আছে। তার আগে আরেকটা ইস্যু দেখে আসি।
গত চার পাঁচ বছর দেশের অর্থনৈতিক বুম পজিশনে ছিল। জিডিপি গ্রোথ রেট ৭ এর বেশি ছিল টানা অনেক সময়। অনেক মেগা প্রজেক্ট ছিল। মানুষের হাতে এবং বাজারে প্রচুর টাকা ঢুকেছে।
এর ফলাফল আমরা দেখতে পাই, সবার হাতেই ভাল স্মার্টফোন, হঠাৎ করেই মানুষ সৌখিন হয়; ট্যুর দিচ্ছিল প্রায় ম্যাক্সিমাম এমন মানুষ যাদের স্থায়ী ইনকাম নেই বা কম। কিন্তু নানান ভাবে টাকা আসছিল যেমন টিউশন বা ফ্রিল্যান্সিং ইত্যাদি।
ইকোনোমি বুম করলেও দেশের ব্যাংকিং সেক্টর ধুকছিল। বিশাল বিশাল এমাউন্টের টাকা পাচার, ব্যাংকের মুলধন ঘাটতি নিয়মিত ঘটনা ছিল। এমনকি অনেক ব্যাংক গ্রাহকদের টাকাও ফেরত দিতে পারছিল না। এবং দেশের শেয়ার বাজার ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি।
খুব স্বাভাবিকভাবেই ব্যাংক মানুষকে টাকা জমাতে আগ্রহী করতে পারেনি। মানুষ শেয়ারবাজার বা অন্যান্য জায়গায় ইনভেস্ট করতে আগ্রহী বা সাহসী ছিল না। এর পাশাপাশি নানান পণ্যের আগ্রাসী বিপনন মানুষকে ভোগবাদী করে তুলে।
দেশে কার্যত মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণীতে সঞ্চয়ের মানসিকতা সৃষ্টি হয়নি কিংবা সৃষ্টি করা যায় নি।
এই পরিস্থিতিটা একটা "সমস্যা" হিসেবে চিহ্নিত হয় যখন কভিড ১৯ শুরু হয়!
হঠাৎ করেই সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে যায়। ১৮/১৯ বছর ধরে চাকরি করা মানুষগুলোর তিন মাস চলার মত সঞ্চয় ছিল না!
এটা একটা ভয়াবহ একটা অবস্থা! বিশেষ করে দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির জন্যে এটা অস্বস্তিকর। সঞ্চয় না দাঁড়ালে বিনিয়োগ বাড়বে না। মেগাপ্রোজেক্ট বা এসব দিয়ে দীর্ঘমেয়াদে দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না।
এখন,
রিক্সাওয়ালা মামার গল্পে ফিরি।
তাকে পরামর্শ দেওয়ার মত কেউ ছিল না। তিনি চাইলেই দিনে ১৬০০/১৯০০ টাকা আয় করে বাকি ৫০০/৬০০ টাকা সঞ্চয় করতে পারতেন। কিন্তু করেন নাই কেন?
কারণ হিসেবে বের করা যায়, জ্ঞানের ঘাটতি এবং সঞ্চয়ের সুযোগের ঘাটতি।
আমরা কি সঞ্চয় নিয়ে নিম্নবিত্ত মানুষদের সচেতন করতে পেরেছি? বা আপনি নিম্নবিত্ত কাদের বলছেন? আপনি কি জানেন একজন সিএনজি চালাক যিনি বস্তিতে থাকেন তার মাসিক ইনকাম ৬০ হাজার টাকারো বেশি? আপনারা যারা এই আর্টিকেলটা পড়ছেন, আপনাদের অনেকের চেয়েও তার আয় বেশি!
তাহলে তারা মাসে ৬০ হাজার টাকা আয় করেও বস্তিতে থাকে ও নিম্নবিত্তের কাতারে কেন? আপনি আমি না কেন?
এটা একটা মজার ইস্যু। Social Stratification নিয়ে পরে আরেকটা আর্টিকেল লিখবো আশাকরি।
সে যাক,
বস্তিতে যারা থাকে, প্রায় সবাই বস্তি ভিত্তিক সমিতি করে যার টাকা প্রায়শই ঠিকমতো পায় না। আবার তারা হিসেব জানেনা তাই ঠকে।
আমাদের যে ব্যাংকিং সিস্টেম আছে তারা বেশিরভাগই কর্পোরেট ব্যাংকিংয়ে আগ্রহী। অথবা মধ্যবিত্তদের জন্যেই পরিচালনা করে। যেটা আমাদের অর্থনীতির জন্যে ভাল না।
এই ৭০/৮০ টা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান দেশের কত শতাংশ মানুষকে সার্ভিস দেয়? এটা ভাবার সময় চলে এসেছে।
সে যাক,
রিক্সাওয়ালা মামা এখন বুঝেছেন,
সঞ্চয় গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অনেক দেরী করে ফেলেছেন। তবুও আশাকরি তার সন্তান সুস্থ হয়ে উঠবে।
এই করোনা আমাদের সঞ্চয় এবং অযাচিত ব্যয়হ্রাস নিয়ে অনেক কিছুই শিখিয়েছে। তবে ভাল হত যদি আগেই শিখা থাকতো।
এবার সঞ্চয় ও বিনিয়োগ নিয়ে কিছু ধারণা নেওয়া যাক।
আয়ের যে অংশ বর্তমান ভোগের জন্য ব্যবহার না করে ভবিষ্যতের জন্য জমা করা হয়, তাকে সঞ্চয় বলে। অর্থাৎ মোট আয় থেকে ব্যয় করে যা অবশিষ্ট থাকে, তা-ই সঞ্চয়। যেমন ধরা যাক, কোনো ব্যক্তির মাসিক আয় ১০ হাজার টাকা। তিনি তা থেকে ৭ হাজার টাকা ব্যয় করেন এবং ৩ হাজার টাকা ভবিষ্যতের জন্য রেখে দেয়ন। এই ৩ হাজার টাকাই হলো সঞ্চয়।
কিন্তু মানুষ কেন সঞ্চয় করে?
মানুষ নানান কারণে সঞ্চয় করে। তবে সাধারণত দুটা কারণের আধিক্য থাকে।
১। অনিশ্চিত ভবিষ্যতে নিরাপদ থাকার জন্যে।
২। বেশি জমানো হলে ব্যবসা বা স্থায়ী সম্পদ যেমন জমি কিনা বা বাড়ি বানানোতে ব্যয় করার জন্যে।
কিন্তু সঞ্চয় কেন গুরুত্বপূর্ণ?
সঞ্চয় নানান কারণে গুরুত্বপূর্ণ। যেমনঃ
- সঞ্চয় ভোগকে সীমিত করে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার হলেও ব্যবসায়ীরা নানানভাবে এই পয়েন্ট বাদ দিতে চেষ্টা করে। সমাজে যেহেতু সম্পদ নির্দিষ্ট, তাই পণ্যের দাম বাড়বেই। তবে নানান কারণে ব্যবসায়ীরা চায় বর্তমানেই যত সম্ভব বেশি বিক্রি করা। তাই তারা সঞ্চয়কে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করে। অপ্রয়োজনীয় ভোগ অর্থনীতি এবং মানুষ কারোর জন্যেই ভাল না।
- সঞ্চয় এর মাধ্যমেই বিনিয়োগ সৃষ্টি হয়। আপনার টাকা না থাকলে তো আপনি ব্যবসায় বা কিছুতে বিনিয়োগ করতে পারবেন না! কিন্তু বিনিয়োগ কি?
বিনিয়োগ:
সহজ ভাষায়, ভবিষ্যৎ লাভের আশায় অর্থ বা সম্পদ ব্যবহার করাই বিনিয়োগ। ধরুন, আপনার কাছে ক্যাশ টাকা আছে, আপনি ১০০,০০০ টাকা দিয়ে একটা দোকান দিলেন। এয়াতাই বিনিয়োগ।
কিন্তু বিনিয়োগ কেন গুরুত্বপূর্ণ?
বিনিয়োগের ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক গুরুত্ব আছে।
ব্যষ্টিক গুরুত্ব হচ্ছে, বিনিয়োগকারীর আর্থিক লাভের সম্ভাবনা। সামষ্টিক হিসেবে বলা যায়, কর্মসংস্থান সৃষ্টি। যেমন আপনি একটা ব্যবসা শুরু করলে ১০ জনকে নিয়োগ দিবেন। এটা দেশে কার্যত বেকারত্ব হ্রাস করবে।
সঞ্চয় করুন। যথাযথ বিনিয়োগ করুন।
রিক্সাওয়ালা মামার মত সবাই তাও অন্তত শিখুক। মাঝেমধ্যে জীবন যখন শিখায়, বিনিময়ে অনেক বেশি মূল্য নিয়ে ফেলে।
ভাবতে ভাবতেই বাসার কাছাকাছি চলে আসলাম। পায়ের ব্যথা বাড়ছিল। গরম বাড়ছিল চারপাশে, তবুও রিক্সার হুড নামিয়ে রাখলাম। তীব্র রোদও উপভোগ্য যদি মাসে পর মাস চার দেয়ালে বদ্ধ থাকতে হয়।
No comments